বয়স তখন হয়তো ১২-১৩ বছর। তখন থেকেই দেখেছি সংসারের অভাব।
সে সময় থেকেই আমরা একবেলা খেয়ে না খেয়ে বড় হয়েছি।
একদিন রাতের বেলায় মা আমাদের পাঁচ ভাই-বোনকে খাবার দিলেন, আমরা পেটপুরে খেয়ে উঠলাম।
মাকে প্রশ্ন করলাম খাবে না, মা বললো পরে খাব। আমার মন মানছিল না।
সবাই চলে যাওয়ার পর পাত্রে দেখলাম খাবার নেই। কাঁদলাম। শপথ নিলাম, বড় হলে মাকে বেশি করে খাওব।
দু’দিন বাদে আমার আর ছোট ভাইয়ের অষ্টম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষা। ফিস দেওয়া হয়নি।
ক্লাসে গেলাম, স্যার বললেন, আজ ফিস জমা না দিলে তোমরা পরীক্ষা দিতে পারবে না।
দৌঁড়ে বাসায় ফিরলাম।
দেখি বাসায় খাবারও নেই। কি করে মাকে বলি পরীক্ষা ফিসের কথা, তারপরও বললাম।
মায়ের দু’চোখ দিয়ে পানি ঝরল। এরপর তিনি পাসের বাড়ির মহিলার কাছে তার কানের দুল বিক্রি করে নিয়ে এলেন ৩০০ টাকা। আমার হাতে তুলে দিলেন সব টাকা।
কান্না পেল অনেক। মাকে তা বুঝতে দেইনি। মনে মনে শপথ নিলাম বড় হয়ে মায়ের অভাব দূর করব।
বাবা চড়ই পাড়ায় দোলনা নিয়ে গেছেন। দু’দিন ধরে বাসায় রান্না হয়নি।
আমি আমার ছোট ভাই ও মেঝ বোন দৌঁড়ে স্কুল থেকে বাসায় ফিরলাম।
বাবা বাজার নিয়ে আসবে, আমরা আজ পেট ভরে খাব। বাসায় এসে দেখি বাবা খালি হাতে ফিরেছেন।
চড়ই পাড়ায় দোলনা নিয়ে যাবার সময় মা যে ৫০০ টাকা ধার করে দিয়েছেন তাও লস করে এসেছেন।
আজও ভাত রান্না হয়নি। মা আমাদের জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। মনে মনে শপথ নিলাম বড় হয়ে মায়ের সব দুঃখ মুছে ফেলব আমি।
দাদি মারা যাবেন রাতেই। গত দু’দিন বাসায় রান্না হয়নি। বাবা লামায় চাকরিত।
রাত ১২টার দিকে দাদির শেষ অবস্থায় তিনি আম্মুকে বললেন, মা খুব খিদে পেয়েছে, আমাকে একটু খাবার দাও।
দুঃখীনি মায়ের গল্প
মা তাকে বললেন, আজ রান্না হয়নি মা। দাদি বললেন, ঠিক আছে কাল খাব। কিছুক্ষণ পর না খেয়েই মারা গেলেন দাদি।
মা সেই দৃশ্য মনে করে সারাটা জীবন কেঁদেছেন। মায়ের কান্না দেখে শপথ নিলাম, মায়ের সব অভাব আমি দূর করব।
রাতে রান্না করার জন্য পাশের বাড়িতে দু’পট চালের জন্য গেছেন মা। আমি পড়তে বসেছি।
খালি হাতে ফিরে মা বলল, চালত দেয়নি। আগের আনা চাল দিতে পারিনি বলে তারা আমাকে অপমানিত করেছে।
মাকে জড়িয়ে ধরে আমিও কাঁদলাম। শপথ নিলাম, এই অভাব আমিই দূর করব।
আজ আমার সংসারে অভাব নেই। আমার করা শপথ আমি রেখেছি। দারিদ্র্যকে আমি জয় করেছি।
তবে যার জন্য আমার এই জয় সেই মা আজ নেই। তিনি জীবনে পরাজিত হয়ে চলে গেছেন পরপারে।
মায়ের সেই স্মৃতি মনে করে এখনও আমি কাঁদি, নিজের অজান্তে কাঁদি।
গভীর রাতে কেঁদে উঠি, মাকে বলি ফিরে এসো মা। দেখো তোমার ছেলে গাড়িতে চড়ছে।
তোমার ছেলেকে অনেকে স্যার বলে ডাকছে।
মাতো ফেরে না।
মাকে বলি, আমায় ক্ষমা করো মা, আমি তোমাকে সুখী করতে পারলাম না।
তোমার মৃত্যুর পরই এলো আমার সব সচ্ছলতা। ক্ষমা করো মা, ক্ষমা করো আমাকে।
ফিরে দেখা : ২৩ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা, আমার মাকে শেষ গোসল করালেন আত্মীয়-স্বজনেরা।
সাদা কাফনে জড়ানো হলো তাকে। আমি বুঝতে পারছিলাম এটাই আমার মায়ের শেষ যাত্রা।
মায়ের লাশ কাঁধে তুলে নিলাম আমি। এক পা-দু’পা করে আমরা পৌঁছে গেলাম স্টেডিয়ামের কেন্দ্রীয় কবর স্থানে।
আমি যেন অনুভূতিহীন হয়ে পড়লাম। মাকে কবরস্থ করার জন্য খোঁড়া কবরের ভেতরে নামলাম।
চিরদিনের জন্য নিজের হাতেই মাকে শুয়ে দিলাম মাটির কবরে। নিজের হাতে মায়ের উপর মাটি চাপা দিলাম।
এরপরেই আমার অনুভূতি ফিরে এলো, আমি বুঝতে পালাম আমার চির দুঃখিনী মা আমাকে ছেড়ে চিরদিনের জন্য চলে গেল। আর কোন দিন তিনি আমাকে বাবা বলে ডাকবেন না।
আমার মায়ের মৃত্যুর সময় আল্লাহর কাছে আমারও মৃত্যু কামনা করেছিলাম।
কিন্তু সময়ের ব্যবধানে শোক কাটিয়ে উঠতে পারলেও আমার মা এখনও আছে আমার অস্তিত্ব জুড়ে।
আমি এখনও কাঁদি, মাঝে মাঝে সকলের অজান্তে কাঁদি। আমার মা শামসুর নাহার, ২৩ ডিসেম্বর ২০০৯ সকাল ১০টায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন (ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাইহি রাজিউন)।
সাতকানিয়ার কাঞ্চনায়তায় এক কৃষক পরিবারে তার জন্ম।
বার বার তাদের অভিশাপ দেই :
মৃত্যুর আগে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি বিছানার চাদরও জোটেনি আমার মায়ের ভাগ্যে।
আমার পরিবারের সদস্যদের শত আকুতি কানে যায়নি মেডিকেল কলেজহাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কানে।
ডাক্তার-নার্সদের অবহেলা আর চরম দুর্ব্যবহারে রোগীদের জীবন বিষিয়ে তুলেছিল।
২২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট নিয়ে আমার মাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে বান্দরবান সদর হাসপাতাল থেকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আশা হয়।
চট্টগ্রাম মেডিকেলে পৌঁছানোর পর এক ওয়ার্ডবয় এগিয়ে আসেন ট্রলি নিয়ে।
আমার মাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালের ১৩ নাম্বার ওয়ার্ডে। তাকে উপরে তোলার পর চিকিৎসা শুরুর আগে সেই ট্রলিবয় আমার পিছু ধরে টাকার জন্য।
ভাংতির অভাবে তাকে ২০ টাকা দিলে সে আরও টাকা দাবি করতে থাকে।
পরে অন্যজনের কাছ থেকে আরও দশ টাকা নিয়ে তাকে দেই।
মাকে ওয়ার্ডে নেওয়ার পর প্রায় আধাঘণ্টা ফেলে রাখা হয়। এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকি। বার বার ডাক্তারের শরণাপন্ন হই।
কিন্তু তারা তো ডাক্তার! আমার মতো মফস্বল শহরের মানুষের চিকিৎসা করার সময় তাদের হাতে নেই।
মার শ্বাসকষ্ট বাড়তেই থাকে, সঙ্গে আমাদের উদ্বেগও। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা পর আসেন এক ডাক্তার সাহেবা।
তিনি দয়া করে আমার মাকে দেখেন। আমাদের আগের চিকিৎসাপত্রগুলো নিয়ে যান। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর আরও প্রায় আধাঘণ্টা গেল। আমি এ সময় আবারও ছুটে গেলাম ডাক্তারের কাছে।
ডাক্তার জানালেন, একটি টেস্ট দেওয়া হয়েছে। রিপোর্ট পাওয়ার পর চিকিৎসা দেওয়া হবে। এবার অপেক্ষার পালা।
এভাবে চলে যায় প্রায় দুই ঘণ্টা। এরই মাঝে অক্সিজেন ছাড়া থাকতে থাকতে আমার মা আধামরা হয়ে পড়েন।
চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র দেওয়ার পর শুরু হয় আমার দৌড়াদৌড়ি।
ডাক্তার পরামর্শ দেন অক্সিজেন দেওয়ার জন্য। কিন্তু এত বড় হাসপাতালে আমার মায়ের জন্য একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার যোগাড় করা যায়নি।
পরে হাসপাতালের পাশের শুভ ফার্মেসি থেকে দুই হাজার টাকা জমা দিয়ে এবং দৈনিক ৫০০ টাকা ভাড়ায় অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে আসি।
ফার্মেসি থেকে ওষুধ আনার পর তা মার শরীরে পুশ করতে নার্স খুঁজতে থাকি। কিন্তু সেখানেও বিড়ম্বনা।
রাত ১১টার দিকে মার অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে। আমি ডাক্তার মহোদয়কে আবার ডেকে আনি।
তিনি জানালেন, মা ভালো হয়ে যাবে। তাকে না দেখেই ডাক্তার চলে যান।
রাত যতই বাড়তে থাকে মার শ্বাসকষ্ট আরও বাড়তে থাকে। রাত ৩টার সময় আমার অনুপস্থিতিতে আমার বড় বোন সাগেরা বেগম মায়ের অবস্থা খারাপ দেখে আবারও ডাক্তারকে ডেকে আনেন।
ডাক্তার জানালেন, মায়ের অবস্থা ভালো নয়।
এ সময় তিনি আরও স্যালাইন ও ইনজেকশন কিনে আনার পরামর্শ দেন।
পরে তা মার শরীরে পুশ করার জন্য বড় আপা কয়েকবার নার্সের শরণাপন্ন হলেও তারা আসেননি।
নার্স জানান, তাদের নাস্তা করা শেষ হলে তারা আসবেন।
প্রায় আধাঘণ্টা পর নার্স এলেন। দেরি করার কারণ জানতে চাইলে তিনি আমার বোনকে বকাঝকা করেন।
এভাবে কেটে যায় একটি রাত। সকাল পৌনে ১০টায় কর্তব্যরত ডাক্তার জানালেন, আমার মা আর নেই।
মৃত্যুর পরও আমার মায়ের নিস্তার মেলেনি। লাশ নিয়ে শুরু হয় ওয়ার্ডবয়দের টানাহেচড়া।
লাশ আনার জন্য হাসপাতালের দুই ওয়ার্ডবয়কে আমাদের দু’শ’ টাকা দিতে হয়।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রোগীদের হয়রানির যেন শেষ নেই। ওয়ার্ডগুলোতে নেই পানি।
টয়লেট ব্যবস্থা একেবারে ভেঙ্গে পড়েছে। রাতের বেলায় নার্স, ওয়ার্ডবয়রা চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে রোগীদের মূল্যবান জিনিসপত্র। ডাক্তার-নার্সদের খারাপ ব্যবহারে রোগীরা অতিষ্ঠ।
সবকিছু মিলিয়ে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল যেন এক অনিয়ম আর দর্নীতির স্বর্গরাজ্য।
Table of Contents